

হাসান রশিদুজ্জামান বিপ্লবঃ বাংলাদেশটাকে আমি পিতৃভূমি বলে থাকি। গৌড়ের সমতলভূমির আম্রকানন সমৃদ্ধ যে জনপদ তাকে বলি মাতৃভূমি। আবার তার ঠিক পাশেই হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য বুকে নিয়ে, ঢেউ খেলানো জমিনের অপরূপ বরেন্দ্রভূমি। আমার চাঁপাই। আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জ।
পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে সাঁওতাল কৃষকদের নিয়ে মানুষের নূন্যতম অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম,সাঁওতাল বিদ্রোহ -তেভাগা। তারই তীর্থস্থল ইলামিত্রের নাচোল।বরেন্দ্রভূমি। আমাদের চাঁপাই। যদিও ব্রিটিশ বিরোধী বীজ সাঁওতাল বিদ্রোহে স্পষ্ট।
দন্ত্য ‘স’ ‘শ’ ‘ষ’ উচ্চারণে বিশেষ যে টোন। তাও অনন্য। অন্তত আমার কাছে। বদলাতে চায়নি। চেষ্টাও করিনি। তা করতে আপন অস্তিত্বের অনুমতি পাইনি। টেনে টেনে মৃদুলা সুরে কথা বলা বিশেষ উচ্চারণের দেশ।আমাদের চাঁপাই।
মহানন্দা নদীবিধৌত ছোট্ট ছিমছাম শহর। ১৯৪৮ সালের তমদ্দুন মজলিসের সাথে প্রথমদিকেই যে ক’টা জনপদ একাত্মবোধ করেছিলো ভাষার প্রশ্নে তার মধ্যে আমাদের মহকুমাও ছিলো। ১৯৭১ সালেও দলে দলে মুক্তিকামী লুঙ্গিপরা তরুন সৈনিকের পায়েচলা পথে কিংবা নৌকায় কালিয়াচক সীমান্তরেখা পাড়ি দেয়া মানুষের আবাস। বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের। দিয়াড়ের দেশ সদর উপজেলা। আমাদের চাঁপাই।
গৌড় শাসন পরিচালনের সুমহান ঐতিহ্য বুকে নিয়ে আমাদের শিবগঞ্জ। কোটি কোটি আমগাছে সুশীতল।আম্রমুকুলের মৌমৌ মাতাল করা সুবাসের। পাগলার ধীর মসৃন বয়ে চলা। কাঁসা ও বয়ন শিল্পের শিবগঞ্জ। আদি চমচমের। আলাউদ্দীন শাহীর ছোট সোনামসজিদের শিবগঞ্জ। তোহাখানার। আমাদের চাঁপাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের আবেগ বীরসৈনিক ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধের পবিত্র জনপদ। সর্বপশ্চিমাংশ। আমাদের চাঁপাই।
অনেক হাটের ভীড়ে অবহেলিত। যা কিছু পুরাতণ তাই-ই অবহেলিত। যে হাটে হাড়ি ভাঙেনি। কোন ভোলার সন্দেশ নাই,তবু ভোলাহাট। বাঙাল সাধু সাধারণের আবাসভূমি ভোলাহাট। বিল- নদী,আম্রমঞ্জরির ভোলাহাট।
রেশমের-পোলুপোকার ভোলাহাট। ঐ দূরে আনন্দের পশরা সাজাই ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’ আমাদের মমতাজউদদীন। আমাদের চাঁপাই।
কাছে তবু দূর। তাকালেই জমির আইল থেকে আরেক আইল মনে হয় কত কাছে। পায়ে হাটলেই কতদূর। বরেন্দ্রভূমি। গোমস্তাপুর।
বুকে নিয়ে ষাড়বুরুজ,ওয়াচসেন্টারের মত হঠাৎ একটা গম্বুজাকৃতি ঘর। কেউ সঠিক জানেনা কি ওটা। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলার কতনা রূপকথা! আনন্দের বিস্ময়ের। রেলব্রিজের পাশের বদ্ধভূমির শহীদদের চোঁখের জল প্রত্যয় ও শেষ আর্তনাদধ্বনি বুকে ধারণ করা পূনর্ভবা। যুবতীবালার চুলের চিকন বেণীর মত পূনর্ভবা।বেলী ব্রিজ থেকে ঝাপদিয়ে পড়া সাথে ইউসুফ মামা রুহুল হাফিজুর স্বপন ভাই। আমার বিকশিত অবিকাশের রহনপুর। আমাদের চাঁপাই।
চটুল রঙ্গরসের আলকাপ গানের চাঁপাই। নানা-নাতির সমাজবাস্তবতার আলেখ্য গম্ভীরা গানের দেশ চাঁপাই।কালাইরুটির, চাটনির। আমাদের। হারঘে। তোরঘে। লবগঞ্জ। রাজবংশী-সাওতালদের। বাইড়ালদের। হামাদের। লবগঞ্জ।
মাটির সাথে শেকড়ের যে সম্পর্ক, আমার সংগে আমার মাতৃভূমিরও তাই। ধর্মভীরু মানুষদের চাঁপাই। তবে ধর্মীয় দাঙ্গাবাজির নয়। নিয়ত স্মরি,নিয়ত পূজি।
ভালোবাসাবাসির বেলে-দোআঁশ মাটির,আম্রশাখা পল্লবপুঞ্জের,মহানন্দার পূনর্ভবার পাগলার গৌড়ের বরেন্দ্রীর ইলামিত্রের। আমাদের প্রিয় চাঁপাই। পিছিয়ে পড়া মানুষদের জনপদ। আমাদের চাঁপাই।
স্যালুট তোমাকে মাতৃভূমি। আমার পিতৃভূমির আর কোন জনপদে জন্ম হয় নাই। আমি গর্বিত। তোমার জঠরে পেয়েছিলাম ঠাঁই।
লেখকঃ
হাসান রশিদুজ্জামান বিপ্লব,
রাজনৈতিক কর্মী!
“জয়বাংলা গম্ভীরা ও আলকাপ বিকাশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।”