ঐতিহাসিক সত্যতা চূড়ান্ত হলে রহনপুর হবে মুসলমান রাজ্য স্থাপনের প্রথম জনপদ

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ৬:৫৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১০, ২০২০

কায়সার রহমানীঃ ইতিহাস চূড়ান্ত মীমাংসা এখনো দিতে পারেনি। কুয়াশায় আড়াল হয়ে সূর্যের দিকে হাত বাড়িয়ে আলোতে আসতে চাচ্ছে বাংলার এক লুকনো, দুর্দান্ত ইতিহাস। এই ইতিহাসের ঐতিহাসিক সত্যতা চূড়ান্ত হলে বাংলার ইতিহাসে আসবে নতুন মোড়।

অসীম সাহসী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে রাজা লক্ষণ সেন নদীয়ায় পালিয়ে যান। কিন্তু লক্ষণ সেনের এ নদীয়ার অবস্থান কোথাই ? ইতিহাস তার সঠিক সিদ্ধান্ত এখনো দিতে পারেনি। চলছে তর্ক- বিতর্ক । আর এ বিতর্ককে বাড়িয়ে তুলেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানার রহনপুরে অবস্থিত নওদাবুরুজ বা ষাড়বুরুজ।

রহনপুরের নওদা বুরুজ নিয়ে বেশ কিছুকাল ধরে কোন কোন মহল থেকে দাবি উঠছে যে , এখানেই অবস্থান ছিল নদীয়া না নদীহ শহরের। অনেকেই বলছেন, এই স্থানেই ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি তার দ্বিগ্বিজয়ী নাঙা তলোয়ার উচিয়ে বিনা প্রতিরোধে আক্রমন করেছিলেন রাজা লক্ষণ সেনকে। বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন ভয়ে ভীত হয়ে নওদা বুরুজের পেছনের দরজা দিয়ে নগ্নপদে বিক্রমপুর চলে যান পালিয়ে ।

নওদা বুরুজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা রহনপুরের খোঁয়াড়ের মোড় থেকে সোজা প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটি ষাঁড়বুরুজ হিসেবে পরিচিত। দেখতে অনেকটা বড়সড় ঢিবির মতো। নদী মহানন্দা ও পুনর্ভবার মিলনস্থলের কাছেই নওদা বুরুজের অবস্থান। দেখতে ঢিবির মতো মনে হলেও, অনুসন্ধানী চোখে দেখলে মনে হবে, তমশাচ্ছন্ন ইতিহাসের কালো মেঘে ঢাকা স্থানটি । চেপে থাকা হাজার বছরের ইতিহাস যেন বুক চিড়ে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে ।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
https://youtu.be/YAmr0D3U8SQ

নওদা বুরুজ মূল ভূমি থেকে প্রায় ৭৪ ফুট উঁচু। পৌনে ৮শ ফুট পরিধি এই বুরুজের। দেখলে বুঝা যায় এর নীচে ভাঙা অট্টালিকার মতো কিছু রয়েছে। এটি খাড়া নয়, অনেকটা পিরামিডের মতো। ৫ থেকে ৬ ফুট মাটির স্তরের পরই ইটের শক্ত ছাদের অবস্থান। বুরুজের চারপাশ মূলভূমি থেকে ৪ ফুট উঁচু। নওদা বুরুজের উত্তর আর পূর্ব দিকে মজে যাওয়া পরিখা দেখা যায়। এর চারপাশে খাড়ি বা খাল ছিল। যা পুণর্ভবার নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। গবেষকদের ধারণা এ খালকে সেকালের নিয়মানুযায়ী প্রতিরক্ষা খাল হিসেবে খনন করা হয়েছিল।

নওদা বুরুজ থেকে বাংলার রাজধানী গৌড় লক্ষণাবতী ও রামাবতীর অবস্থান দুই প্রতিবেশি জেলা মালদহ ও নবাবগঞ্জের ২৫ থেকে ৪০ মাইলের মধ্যে। আর নবদ্বীপ হচ্ছে গৌড় থেকে দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ জেলা পার হয়ে প্রায় শত মাইলের ব্যবধানে। নবদ্বিপে মন্দির ছাড়া রাজকীয় স্থাপনার কোন নিদর্শন ওখানে নেই ,যাতে নবদ্বীপকে প্রাচীন বাংলার রাজধানীর মর্যাদা দেয়া যেতে পারে। অন্যদিকে নওদা বুরুজ আর এর চারপাশের এলাকা নগরসভ্যতার নান আলামত ও নিদর্শনাদিতে পরিপূর্ণ। আর ভৌগলিক অবস্থান অত্যান্ত বৈশিষ্ট মন্ডিত।

সুলতানী যুগের ইতিহাসবিদ মীনহাজ-ই সিরাজের “তবকাত ই নাসিরী” গ্রন্থের বরাত দিয়ে ইতিহাস গবেষকদের একটা বড় অংশ জানিয়েছেন, মিনহাজের উল্লেখ করা নদীয়ার অবস্থান গঙ্গা-মহানন্দা আর করতোয়ার মাঝখানে। সুতরাং জায়গাটি যে আসলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নওদা সেটা অনেক ইতিহাসবিদ সমর্থন করেন। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট ইতিহাস অনুসন্ধানী কাজী এম মিসির তার গ্রন্থে অনুমান করেছেন, বরেন্দ্রী শাসনের জন্য গঙ্গা-মহানন্দা-পুণর্ভবার সঙ্গমে আরেকটা রাজধানী স্থাপন করে নাম দেয়া হয়েছিল নওদা, যা জনশ্র্রতির নওদা বুরুজ।


জানা যায়, মধ্যযুগীয় বাংলার সেন রাজবংশের চতুর্থরাজা রাজা লক্ষণ সেনের আমলে (১১৭৮-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) রহনপুর বাণিজ্য নগরী হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে কারণে রহনপুরেই তিনি গড়ে তোলেন সুরম্য অট্টালিকা। বাংলা বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এই পথেই বাংলায় আগমন করেন।

সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া নওদা বুরুজে বেশ কয়েকবার খননকাজ চালানো হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন মহাকুম প্রশাসক, এ স্থান হতে বেশ কিছু প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ করেছিলেন। এটি খনন করে দরজা, বৌদ্ধ মূতী, গণেশ মূর্তী, তেঁতুলের বিঁচির মতো আরবী অক্ষর লেখা বেশ কিছু মুদ্রা, পোড়া মাটির ভাস্কর্য, বিভিন্ন মুদ্রা প্রভৃতি অনেক প্রত্মসম্পদ পাওয়া যায়। যার এখন কোন সন্ধান পাওয়া যায়না।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বুরুজের চারপাশে বিভিন্ন বনজ গাছ লাগানো হলেও, সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো বিনষ্ট হওয়ার পথে। অবৈধ দখলদাররা এর চারপাশে গড়ে তুলেছে অসংখ্য বসতবাড়ি। তারা এ অট্টালিকা খুঁড়ে ইট, খোয়া নিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে নামমাত্র সাইনবোর্ড লাগানো হলেও কোনো নজরদারি নেই। ফলে দখল হয়ে যাচ্ছে রাজা লক্ষণ সেনের বাড়ি হিসেবে খ্যাত নওদা বুরুজ।

এতসব তথ্য , যুক্তির পরও এখনো সরাসরি কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। কেননা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন বিবরণ পাওয়া যায়নি। তাই পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ, গবেষণা ও বাস্তবতার কাছাকাছে যাবার প্রয়োজনীয়তা আছে। ঐতিহাসিক কোন সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হলে, ক শ্রেণীর রহনপুর বাংলার অতীত রাজধানীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে। নওদা বুরুজ হবে, বাংলায় প্রথম মুসলমান রাজ্য স্থাপনের প্রথম জনপদ।

লেখক :কাইসার রহমানী
সাংবাদিক ও লেখক

পোস্টটি শেয়ার করুন