তামজিদ হাসান তুরাগ ও সজিব ঘোষ: আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৯টি মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়। এসব প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার নাম দিয়েছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প। অর্থনৈতিক চাপ সত্ত্বেও প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে।
৯টি প্রকল্পের মধ্যে মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। অন্যগুলোর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের কাজ ৮৭ শতাংশের ওপরে শেষ হয়েছে। বাকি পাঁচ প্রকল্পের কাজও অর্ধেকের বেশি হয়েছে।
গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া এই প্রকল্পগুলো হলো : পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু-মিয়ানমারের কাছের ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়াল গেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।
জানতে চাইলে মেগাপ্রকল্পগুলোর অগ্রগতি প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ৯টি মেগাপ্রকল্পের ঘোষণা দেয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব আমাদের কোনো মেগাপ্রকল্পে পড়েনি। কাজ চলছে দুর্বার গতিতে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, মেট্রো রেলের একাংশ চালু হবে শিগগিরই। এগুলো অর্থনীতিতে অনেক লভ্যাংশ যোগ করবে। সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন হবে। ’
পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প : পদ্মা সেতুতে রেল চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্পটি। এর বাস্তবায়ন মেয়াদ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৬.৩৩ শতাংশ। এ ছাড়া প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ শতাংশ।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র : দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতিকে অন্যমাত্রায় উন্নীত করতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম এই প্রকল্প। ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ী এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে এই মেগাপ্রকল্পের।
আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্য বলেছে, নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ৫৬.০৮ শতাংশ। আর ভৌত অগ্রগতি ৬৯.৬২ শতাংশ।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প : বাগেরহাটে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৮.৫৩ শতাংশে। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৯.৫৮ শতাংশ।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর : এটি দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দর হলে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ অনেকটা নিরসন হবে। চার হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুবিধা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে কাজ। নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৫৭৬ কোটি চার লাখ টাকা। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ, ভৌত অগ্রগতি ৮৭.৭১ শতাংশ।
দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেল ট্র্যাক নির্মাণ : দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত।
প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, এই এলাকাজুড়ে একটি প্রকল্প। তবে এক প্রকল্পকে দুই অংশে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার পর্যন্ত অংশের কাজ হয়েছে ৭৭ শতাংশ। আর ঘুমধুম অংশের কাজ শুরু করা হয়নি।
১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু-মিয়ানমারের কাছের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্পটির মেয়াদ শুরু হয় ২০১০ সালের জুলাই থেকে। আর কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের জুনে। তবে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে সাত হাজার ১০০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ৩৯.৩৭ শতাংশ। তবে এই প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৭ শতাংশে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিটি প্রকল্প আলাদা, তাই সমন্বিতভাবে বলার সুযোগ কম। তবু এই প্রকল্পগুলো চালু হওয়ার পর অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে। আবার সামাজিক সুবিধাও আছে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে দ্রুত যাতায়াত করতে পারবে। জীবনযাত্রা সহজ ও আরামদায়ক হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুই ধরনের গুরুত্বই বহন করে।
__কালের কন্ঠ