দুর্নীতির আতুড়ঘর বাঘা পৌরসভা

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ৫:০৪ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২২

আবুল কালাম আজাদ (রাজশাহী): দুর্নীতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে রাজশাহীর বাঘা পৌরসভা। রাজস্ব আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, উন্নয়নের নামে লুটপাটসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে পৌরসভার মেয়রসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তহবিলে টাকা না থাকায় প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভার স্থায়ী-অস্থায়ী ৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বকেয়া থাকে মাসের পর মাস। তারপরও পৌর মেয়র মো. আবদুর রাজ্জাকের মনোযোগ কর্মচারী নিয়োগের দিকেই। এই নিয়োগ নিয়েও বাণিজ্য করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। তিনি ২০২০ সালের অক্টোবরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও এ পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে রেখেছেন।

চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের রাজশাহীর উপ-পরিচালক শাহানা আখতার জাহান বাঘা পৌরসভা পরিদর্শনে গিয়ে নানা অনিয়মের সততা পান। তিনি পরিদর্শন প্রতিবেদনে লিখেছেন, নারায়ণপুর হাট বার্ষিক ইজারা না দিয়ে মাসে মাসে ভাড়া দেওয়া হয়। প্রতিমাসে হাটের আদায় করা অর্থ কোন খাতে জমা হয় তার কোন প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বাংলা ১৪২৬ থেকে ১৪২৮ সনের ওই হাটের ৭-ভূমি রাজস্ব ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে কোন অর্থ জমা করা হয়নি। তিনি এসব অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব ক্যাশবহিতে লেখার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপরও এখনও নানা অনিয়ম চলছে এই পৌরসভায়।

অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১২ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আামির হোসাইনের নেতৃত্বে উপসহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ও সহকারী পরিদর্শক মাহবুবুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত একটি এনফোর্সমেন্ট টিম পৌরসভায় অভিযান চালায়। অভিযানেও নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।

অভিযানের পর দুদকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, বাঘা পৌরসভার মেয়র আবদুর রাজ্জাক ও প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভুয়া প্রকল্প প্রস্তুত করে জালিয়াতির মাধ্যমে পৌরসভার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা পৌরসভা কার্যালয় থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কদমতলা ডব্লিউ বিএম দ্বারা রাস্তা উন্নতিকরণ প্রকল্পের রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন এবং সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। টিম রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের রাজশাহীর উপপরিচালক শাহানা আখতার জাহান ফেব্রুয়ারিতে তাঁর পরিদর্শন প্রতিবেদনে লিখেছেন, সর্বশেষ ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়েছে। বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য তিনি নির্দেশ দেন। কিন্তু এখনও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন বকেয়া পড়ে আছে। সম্প্রতি শুধু একমাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। বেতন পরিশোধে মেয়র ব্যর্থ হলেও ২০২০ সাল থেকেই তিনি ১০ জনকে নিয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ জন্য অপ্রচলিত পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। অভিযোগ ওঠে, গোপনে ১০ জনকে নিয়োগের চেষ্টা করছেন মেয়র।

এ নিয়ে ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মেয়র আবদুর রাজ্জাক সীমাহীন দুর্নীতি ও সরকারী অর্থ আত্মসাত করে যাচ্ছেন। মৌখিকভাবে তাঁকে সতর্ক করা হলেও তিনি সংশোধন হননি। মেয়র ১৪২৫ থেকে ১৪২৮ বাংলা সনের হাট-বাজার ইজারার প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা এবং দরপত্রের ৯৬ লাখ টাকা বিডি পৌরসভার হিসাবে জমা না করে আত্মসাত করেছেন। জমা করা হয়নি ভ্যাটও। পৌর এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ১৫ লাখ টাকা খরচ করা হলেও কোন কাজ চোখে পড়েনি।

তিনি অভিযোগ করেন জন্ম নিবন্ধন সনদ, ওয়ারিশ সনদ ও নাগরিকত্ব সনদ বিক্রির টাকাও সরকারী কোষাগারে জমা হয় না। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয় না। কাউন্সিলররা সম্মানী ভাতা পান না। বকেয়া পড়েছে বিদ্যুতের বিলটাও। মেয়র মাসিক সভায় অনুমোদন না নিয়েই ১০ জনকে নিয়োগের চেষ্টা করছেন। এ জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বিষয়টি তদন্তের জন্য আরেক উপসচিব আবুজাফর রিপনকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। একইসঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের জন্য মেয়রকে নির্দেশ দেন। তদন্তে নানা অনিয়ম উঠে এলে উপসচিব ফারুক হোসেন মেয়র আবদুর রাজ্জাককে কারণ দর্শানোর চিঠিও দেন। একই দিন জেলা প্রশাসকের তত্বাবধানে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আরেকটি চিঠি দেন তিনি।

নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দিয়েছিল, মেয়র আবদুর রাজ্জাক দফায় দফায় আবেদন করে এর সময় বৃদ্ধি করেছেন। তবে অনিয়মের অভিযোগ তুলে কাউন্সিলরের বিরোধিতার কারণে এখনও ওই নিয়োগ দিতে পারেননি মেয়র। তিনি বলেন, ‘নানা জটিলতার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারিনি। এটা শেষ করার প্রক্রিয়া চলছে। তবে নিয়োগের আগে টাকা-পয়সা নেওয়ার অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়।’

পৌরসভার অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেন মেয়র আবদুর রাজ্জাক। দুদকের অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুদক তদন্ত করেছে। আমার অপরাধ পেলে ব্যবস্থা নেবে।’ হাট ইজারার টাকা তহবিলে জমা না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাটের সব টাকা পাওয়া যায়নি। ইজারাদাররা টাকা দেননি। তাই ব্যাংকেও টাকা জমা করা যায়নি।’

পোস্টটি শেয়ার করুন