প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত রাজশাহীর শিল্পীরা

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ৪:৪৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২

রাজশাহী প্রতিনিধি; হিন্দু ধর্মালম্বীদের মাতৃত্ব ও শক্তির প্রতীক দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানানোর মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এ পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা আগামী পহেলা অক্টোবর ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে। পূজার সময় ঘনিয়ে আসায় শেষ মুহূর্তে দেবীকে সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজশাহীর প্রতিমা তৈরির মৃৎশিল্পীরা।

শিল্পীদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় ইতোমধ্যে মাটির কাজ শেষ করে চলছে রঙ তুলির কাজ। শিল্পীর রঙ তুলির আঁচড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে দশভূজা দেবীদুর্গাসহ বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমূর্তী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবীদুর্গা শক্তি ও সুন্দরের প্রতীক। প্রতি বছর অশ্বরের বিনাশ কল্পে মা দেবী দূর্গা এই ধরাধামে আবির্ভুত হয়। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার গ্লানি দূর করার জন্যই এই পূজার আয়োজন।

পুজা উৎসবকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে মন্দির গুলোতে চলছে সাজসজ্জার প্রস্তুতি। ইতি মধ্যে খড়, কাঠ, সুতা আর মাটি দিয়ে দুর্গাসহ নানা প্রতিমার কাঠামো তৈরী শেষে এখন চলছে প্রতিমায় রং দেয়ার কাজ। শিল্পী নিপুণ হাতে রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলছেন দেবী দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশসহ নানা প্রতিমা। পুরুষদের পাশাপাশি প্রতিমা তৈরীর কাজে সহায়তা করছে বাড়ির নারী শিল্পীরাও। তবে প্রতিমা তৈরীর উপকরণের দাম বাড়ার কারনে বাড়েছে প্রতিমার দাম।

আগামী ১-৫ অক্টোবর ৫ দিন ব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পুজা অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় শিল্পী ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিল্পীরা এখানে এসে প্রতিমা তৈরি ও রং তুলির কাজ করছেন। অন্যদিকে প্রতিমার পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র ঠিক ও তৈরী করতে ব্যস্ত সময় পার করছে ঢাক-ঢোল, কাঁশি ও বাঁশির কারিগররা। বৈশ্বিক করোনা মহামারি অনেকটা কম থাকায় মাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সকল সনাতন ধর্মালম্বীরা।

প্রতিমা শিল্পী যুগোল কুমার জানান, দু’এক দিনের মধ্যে শুরু হবে রং তুলির আঁচড়। প্রতিমাগুলো মনোমুগ্ধকর ও নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি । আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হবে সকল প্রতিমা তৈরীর কাজ। তিনি আরো বলেন, প্রতিমা তৈরীর উপকরণের দাম বাড়লেও ক্রেতারা প্রতিমার দাম বলছেন কম। বাধ্য হয়ে প্রতিমা বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে খুব একটা লাভের মুখ দেখছি না।

এবছর রাজশাহী নগরীতে ৭০ থেকে ৮০টি পূজামণ্ডপ হবে। নগরীতে কার্তিক চন্দ্র পাল, গণেশ কুমার পাল, অরুণ পাল ও সুশীল পালসহ ১০ থেকে ১১ জন প্রতিমা শিল্পী এ প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন।

রাজশাহী নগরীর আলুপট্টির প্রতিমা তৈরির কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, কার্তিক চন্দ্র পাল ও গণেশ কুমার পালের কারখানার শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির শেষ মুহূর্তের কাজ করছেন। কেউ দেবীর গায়ে দিচ্ছেন তুলির আঁচড় আবার কেউ ব্যস্ত প্রতিমার গায়ে কাঁদা মাটির প্রলেপ লাগাতে।

শ্রী ঋষি কান্ত পালের ছেলে প্রতিমা শিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাল। তিনি প্রায় ১৪ বছর বয়স থেকে এ পেশায় জড়িত। প্রতিমা শিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাল বলেন, ‘সামনে মাসের ৬ তারিখে পঞ্চমী। পঞ্চমীর রাতের আগেই আমাদের প্রতিমার সব কাজ শেষ করতে হবে। এজন্য আমরা এখন খুব ব্যস্ত।’

এবছর নগরীর কুমারপাড়া, ফুদকিপাড়া, আলুপট্টি মোড়, সাগরপাড়া, সাহেববাজার, গণকপাড়া, রাণীনগর, রাজাহাতা, হেতেমখাঁ হরিজন পল্লী, ঘোষপাড়া, সিপাইপাড়া, ফায়ার সার্ভিসের মোড়, সিঅ্যান্ডবি মোড়, অলকার মোড়, কোর্ট হড়গ্রাম, ভেড়ীপাড়া নাবাবগঞ্জ ঘোষপাড়া, কোর্ট হরিজন পল্লী, শ্রীরামপুর (টি বাঁধ), পেতিয়াপাড়া হরিজনপল্লী, চণ্ডীপুর ও লক্ষ্মীপুর ঋষিপাড়াসহ (কামারপাড়া)
নগরজুড়ের বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ হবে। তাই বাংলা আষাড় মাসের ১৫ তারিখ থেকে প্রতিমা শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছে।

কার্তিক চন্দ্র পাল বলেন, ‘গত বছর ১৫টি প্রতিমা তৈরি করে ছিলাম। এ বছর ১৬টি প্রতিমা তৈরি করছি। এগুলোর মধ্যে শহরের জন্য ১১টি প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছি। বাকি ৫টির অর্ডার পেয়েছি শহরের বাইরে থেকে।’

কার্তিক চন্দ্র পাল আরও বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে কাছ শুরু করি কাজ চলে একটানা ভোর ৪টা পর্যন্ত। প্রতিমা তৈরির জন্য আমরা কারখানাতে ৫ জন কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে আমাদের অন্য কোনও দিকে নজর দেওয়ার উপায় থাকে না। খাওয়া দাওয়ারও কোন ঠিক নাই।’

প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি প্রতিমা তৈরি করতে শিল্পীদের সর্বনিন্ম ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিমা তৈরির জন্য তাদের ৩ থেকে ৪ ভ্যান মাটি লাগে। খড়ের আউর লাগে ৫ থেকে ৬ পৌন। এছাড়াও কাঠ, বাঁশ, দড়ি, পেরেক, সুতা ও ধানের গুড়াসহ বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রতি ভ্যান মাটিতে তাদের খরচ হয় ৫০০ টাকা, প্রতি পৌন আউরে খরচ হয় দুইশ টাকা থেকে আড়াইশ’ টাকা। আর বাকি জিনিসগুলোর জন্য খরচ হয় তাদের ৪ হাজার টাকার মত।

একটি প্রতিমা তৈরি করতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। প্রতিমা তৈরিতে চার থেকে পাঁচজন শিল্পী একসঙ্গে কাজ করেন। একেকজন শিল্পী প্রতিমার এক এক কাজে হাত দেন বলেও জানান প্রতিমা শিল্পীরা।

প্রতিমা শিল্পী গণেশ কুমার পাল বলেন, ‘১৩টি প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছি। ৫ জন শিল্পী একঙ্গে কাজ করছি। সকাল ৮টা থেকে একটানা রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করছি।’

বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদ রাজশাহী জেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি তপন কুমার সেন বলেন, ‘এ বছর নগরীর ৭৫ থেকে ৮০টি স্থানে পুজা মন্ডপে পুজা হবে। এজন্য মিলন মন্দির, টাইগার মন্দির ও এ্যাডহড মন্দিরসহ নগরীর বিভিন্ন মন্দিরে প্যান্ডেল তৈরি করাসহ বিভিন্ন কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।’

মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি বিমল কুমার সরকার বলেন, ‘এবছর কয়েকটি স্থানে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা কমেছে, আবার কিছু এলাকায় নতুন পূজা মণ্ডপ হবে। তাই এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত তালিকা আসেনি। তবে এবার নগরের ১২টি থানা এলাকায় মোট ৭০ থেকে ৮০টি স্থানে পূজা মণ্ডপ নির্মাণ করা হবে। পূজার নিরাপত্তার বিষয়ে এখনও প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের কোনও আলাপ হয়নি।’

রাজশাহী মহানগর পুলিশের পুলিশ কমিশনার আবুল কালাম সিদ্দিক বলেন, `মহানগরীতে প্রায় ৮০টি স্থানে মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ মণ্ডপগুলোসহ নগরীজুড়ে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাড়তি পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে পুলিশ-র‌্যাব সদস্যের পাশাপাশি থাকবে সাদা পোশাকে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

পোস্টটি শেয়ার করুন