বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাজনৈতিক কারাবরণ,গণমানুষের বুকে ছাত্রলীগের স্থান এবং ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ৩:১৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২১

হাসান রশিদুজ্জামান বিপ্লবঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে পিতা মুজিব লিখেছেন,

“ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল। এক মাসের মধ্যে আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম,যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।’’ [পৃষ্ঠা ৮৯]

“ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দুই মাস যেতে না যেতেই প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ হরতাল সফল করার।এর আগেই ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭ সালেই গঠিত হয়েছে তমদ্দুন মজলিস।
বঙ্গবন্ধু অনেক জেলার পর জেলা সফর করতে থাকেন সংগঠন দাঁড় করানোর বাস্তবতায়।এই পরিস্থিতিতে পিতা মুজিব ছাত্রলীগের সংগঠন গুছানোর জন্য সচেষ্ট হতে অনুরোধ করে বলেন যে,”যে সব নতুন ছাত্রছাত্রী আন্দোলনে আসবে, তাদের সংগঠনে আনতে হবে। কমিটিতেও স্থান দিতে হবে। আন্দোলনে ছাত্রীরাও এগিয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল স্কুল- এ সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নামার জন্য প্রস্তুত। তাদের সংগঠিতভাবে হরতাল সফল করার কাজে লাগাতে হবে।”

এই বঙ্গের বাঙালির জীবনে ১১ মার্চ একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন, যে দিনটি ভাষার লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৪৮ সালের এই দিন আমাদের সাহসী ছাত্রলীগ ও ছাত্রসমাজ একটি সর্বাত্মক ধর্মঘট পালনের মধ্য দিয়ে ভাষার দাবিকে জোরালো ও আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সে সময়কার উজ্জ্বল ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাস মতে,এটিই ছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রথম কারাবরণ। সেদিন আরো গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদসহ অনেকে।

বলাবাহুল্য, ১১ মার্চ শক্ত প্রতিবাদের যে ভিত রচনা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সরকার ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ১১ মার্চের প্রেক্ষাপট থেকেই ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে।

কেন ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল এবং এর সামাজিক প্রভাবটাই বা কী ছিল? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে। আসলে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে দেশ বিভাগের আগে থেকেই বিতর্ক চলছিল। বিষয়টি প্রথমে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিস্তৃত না হলেও শিক্ষিত সচেতন মহলে বেশ সাড়া ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষার সপক্ষে প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির সপক্ষে এ সংগঠন প্রচার চালাতে থাকে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসেই তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এদিকে ওই বছরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে ভাষা হিসেবে উর্দু প্রচলনের সিদ্ধান্ত ছাত্রদের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ তৈরি করে। ৬ ডিসেম্বর তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়।

সেই সময়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে নেতৃত্ব পর্যায়ের বেশ কিছু বাঙালি প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা হিসেবে উর্দু প্রচলনের সিদ্ধান্ত বিনা প্রতিবাদে গৃহীত হয়। কিন্তু এ সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে প্রতিবাদ এত তীব্র হয় যে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ফজলুর রহমান দায়িত্ব এড়ানোর জন্য বিবৃতি দিয়ে উর্দু প্রচলনের কথা অস্বীকার করেন এবং তাঁরা সম্মেলনে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন বলে দাবি করেন। ফজলুর রহমানের বিবৃতির সবটুকুই ছিল মিথ্যা। কয়েক দিন পর কেন্দ্রীয় সরকার যখন প্রেসনোট দিয়ে সম্মেলনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় তখন সব কিছু পরিষ্কার হয়ে ওঠে। করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকার ছাত্রদের ভেতর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর তমদ্দুন মজলিশের নেতা আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রথম প্রকাশ্যে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সভায় ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং ছাত্রলীগের ছেলেরা ব্যাপক অংশগ্রহণ করে এবং তারপর বিভিন্ন উত্তপ্ত স্লোগান সহকারে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এ বিক্ষোভ মিছিল শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে এবং কয়েকজন মন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে তাঁদের কাছ থেকে বাংলার সপক্ষে সমর্থন আদায় করে। কোনো কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যেই বিক্ষোভকারীদের দাবির সপক্ষে বক্তৃতা দিয়ে সমর্থন জানান।

পূর্ব বাংলা সরকারের মন্ত্রী ও মুসলিম লীগ দলীয় অনেক বিধান পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে সমর্থন করলেও পাকিস্তান গণপরিষদে কিন্তু অবস্থাটা অন্য রকম ছিল। পাকিস্তান প্রথম গণপরিষদের অধিবেশনে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উত্থাপিত হলে মুসলিম লীগের সব সদস্য এর বিরোধিতা করেন এবং কংগ্রেসের সবাই সমর্থন করেন। এ ঘটনাকে স্বয়ং লিয়াকত আলী খানসহ মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতারা সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন হিসেবে গণ্য করেন এবং প্রস্তাবক ও সমর্থনকারীদের কটাক্ষ করে প্রস্তাব বাতিল করে দেন। অবশ্য ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন।

এদিকে গণপরিষদের নেতাদের ওই ভূমিকার কথা ঢাকায় প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্কুল-কলেজে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় এবং তা অত্যন্ত সফলভাবে কার্যকর করতে ছাত্রলীগ ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ কর্মসূচি সফল হয় অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

এ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য তমদ্দুন মজলিশ ও ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীদের ডাকে গণতান্ত্রিক কর্মীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও প্রতিটি হলের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তমদ্দুন মজলিশের শামসুল আলম। এ সভাতেই ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। এ কর্মসূচির সপক্ষে ব্যাপক প্রচার-আন্দোলন চলতে থাকে। অন্যদিকে উর্দু ভাষার সমর্থক সরকারি মহল গুণ্ডামির আশ্রয় নেয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের ওপর গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনা অব্যাহতভাবে চলতে থাকায় এবং ধর্মঘট বানচালের জন্য বিভিন্ন ধরনের অপচেষ্টার কারণে ছাত্রসমাজ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

১১ মার্চকে সফল করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি চলে। আগের দিন রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ সুপরিকল্পিতভাবে দিনটি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১১ মার্চ ব্যাপক ছাত্রলীগ বাংলার ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে; কিন্তু অত্যন্ত শক্ত পিকেটিং করা সত্ত্বেও কিছু কর্মচারী অফিসে যায়। শুধু তা-ই নয়, এ কে ফজলুল হকের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ প্রায় সব আইনজীবী সেদিন কোর্টে যাওয়ার জন্য ছাত্রদের সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঢাকা শহরসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ সকালে ছাত্র-জনতা সচিবালয়ের সামনে সমবেত হতে থাকে। সচিবালয়ে প্রবেশের দুটি গেট ছিল। আবদুল গনি রোডস্থ প্রথম গেটে পিকেটিং করেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ। এ গেট দিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যাতায়াত করতেন।

তোপখানা রোডস্থ দ্বিতীয় গেটে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেন কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ খান, মো. বায়তুল্লাহ প্রমুখ। ঢাকায় সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং করার সময় গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ, শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ খান, নঈমুদ্দিন আহমদ, বায়তুল্লাহ, রণেশ দাসগুপ্তসহ আরো অনেকে। ১১ মার্চের ধর্মঘট শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না। পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বত্র ওই দিন ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে। রাজশাহী ও সিলেটে ১১ মার্চ পিকেটিং করতে গিয়ে অনেকে রক্তাক্ত হয়।

১১ মার্চের কয়েকদিন আগে তিনি খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলা সফরের এক ফাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও সাড় পাঁচ বয়সী কন্যা হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যান। স্ত্রীকে বলেন- জিন্নাহ সাহেব, নাজিমুদ্দিন সাহেব আমাদের উর্দু শেখাতে চান। তোমার মেয়ে স্কুলে গেলে বাংলা পড়বে না, উর্দুতে পড়তে হবে। মানতে পারবা? উত্তরে বেগম মুজিব বলেন- আসুক না কেউ উর্দু পড়াতে, ঝাটা পেটা করব। বাংলা ভাষার মান রাখার জন্য যা কিছু কর, আপত্তি নাই।

গোয়েন্দা সূত্র ( সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম খণ্ড) থেকে আমরা জানতে পারি, ১১ মার্চের হরতাল সফল করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শিরোনামে যে লিফলেট বিলি করেছে সেটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এই লিফলেট স্কুল-কলেজে-দোকানে বিলি হয়।

১১ মার্চ ঢাকার রাজপথে হরতাল সফল করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু পিকেটিংয়ে নামেন শত শত ছাত্রের সঙ্গে। পুলিশের লাঠিচার্যে আহত এক ছাত্রকে তিনি রিকশায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আবার পিকেটিংয়ে বসে পড়েন। কিছু সময় পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। আরও অনেক ছাত্রছাত্রীকে আটক করে নেওয়া হয় কারাগারে।

পাকিস্তানে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জেল।
এবং ১১ মার্চ,১৯৪৮ তারিখেই ছাত্রলীগ জনমানুষের বুকে করে নিলো স্থান!এগিয়ে চললো গৌরব,ঐতিহ্য,সংগ্রাম এবং সাফল্যের অগ্রযাত্রায়।

লেখকঃ
হাসান রশিদুজ্জামান বিপ্লব
সদস্য, চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।
ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।

পোস্টটি শেয়ার করুন