ভুঁইফোঁড় সংস্থা কর্তৃক ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’: বিএনপির প্রতারণা, জালিয়াতি ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব
সম্পাদকীয়: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গত ৮ ফেব্রুয়ারী খুব আনন্দিত উচ্ছসিত হয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন “মাদার অব ডেমোক্রেসি” পুরষ্কার পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। যা নাকি কানাডিয়ান একটি সংস্থা এই পুরষ্কার দিয়েছে! প্রথম হোঁচট খেলেন সংবাদ সম্মেলনেই। সনদে উল্লিখিত তারিখ ২০১৮ সালের। সাংবাদিকদের প্রশ্ন; এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জনের খবর তাহলে এতদিন পর কেন ঘোষণা এলো? তাও আবার এমন একটি সংস্থা যার নাম কখনও কেউ শোনেনি। শুরু হলো পদক নিয়ে রহস্য। যেসব তথ্য এসেছে তা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির জালিয়াতি, প্রতারণা আর রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ।
যেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে রায় দেয় দেন কানাডার ফেডারেল কোর্ট। ২০১৮ সালের ৪ মে দেশটির জুডিশিয়াল রিভিউর আবেদনে ফেডারেল কোর্টের বিচারক জাস্টিস ব্রাউন বিএনপিকে দ্বিতীয়বার ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে অভিহিত করেন। সেখানে কয়েক মাসের মাথায় কানাডিয়ান কোন সংস্থা কর্তৃক সেই দলের নেত্রীকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ পুরস্কার দেয়াটা সব মহলের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তারপরই দেশি বিদেশি গণমাধ্যম খোঁজ খবর শুরু করে সংগঠনটির। তারপর যেসব তথ্য বেরিয়ে আসলো তা বিএনপির জন্য চরম লজ্জাকর ও সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যকর।
পদক প্রদানকারী সংগঠনের নাম দেওয়া হয়েছে কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন( সিএইচআরআইও)। ওয়েবসাইটে সার্চ করলে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট এর নাম ম্যারিও গুইলোম্বোর নাম পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, টরন্টোভিত্তিক এ সংগঠন ২০০৩ সাল থেকে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে আসছে। তবে তাদের ওয়েবসাইটে খালেদা জিয়ার বিষয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির সাথে জড়িত কেউ আন্তর্জাতিক ফিগার নয়। দেখা যায়, সংস্থাটির প্রথম তিন ব্যক্তি একই পরিবারের।
এছাড়াও এই ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এর এশিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মমিনুল হক (যিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের ভাগ্নে) এবং বাংলাদেশ মিশনের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা বেগম। এই দুজনের পরিচয় থেকেই বোঝা যায় সিএইচআইআরও সংগঠনটি কানাডার একটি ভুঁইফোড় সংগঠন। কানাডা বিএনপিতে সক্রিয় মোমিনুল হক নিজেকে একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে পরিচয় দেন। ফেইসবুকে তিনি সক্রিয় ‘মিলন হক’ নামে। সেখানে তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এবং বর্তমান সরকারের বিরোধিতায় নিয়মিত পোস্ট দিয়ে আসছেন।
একাত্তর টিভির প্রতিবেদনে জানা যায়, কানাডার ১৭২৫ ফিঞ্চ এভিনউতে একটি ব্যাপটিস্ট গির্জার ঠিকানায় থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি এক কামরার একটি অফিস, যার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর সংখ্যা একজন, তিনি বিএনপি নেতা মমিনুল হক মিলন।
সংস্থাটির ফেসবুক পেজটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তাদের তেমন কোনো অ্যাক্টিভিটি নেই। গত ৮ ফেব্রুয়ারী পেজের লাইক সংখ্যা মাত্র ৮০টির মতো। সেখানে ছবিতে গড়ে প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা ১৫/২০টির মতো। মন্তব্য হাতেগোণা কয়েকটি। মজার ব্যাপার হলো, মন্তব্যকারীদের অধিকাংশই বাংলাদেশি।
২০১৮ সালে ঢাকাস্থ কানাডিয়ান দূতাবাসে চিঠি দেন মমিনুল হক মিলন। যাতে একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরষ্কার টি দূতাবাসের পক্ষ থেকে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু কানাডিয়ান দূতাবাস তা সরাসরি প্রত্যাখান করে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মারিও গুইলোম্বো জানিয়েছেন, এই পুরস্কার নিয়ে সংস্থাটির ইন্টারন্যাশনাল সেক্রেটারি বা হেড অফিসের সেক্রেটারিরা কাজ করেননি। এটি তাদের অর্গানাইজেশনের এশিয়া মিশনের বিষয়। খালেদা জিয়াকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি মূল অফিসের নয়।
শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ফেসবুক লাইভে এক আলোচনায় কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’-এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর এ কথা জানান। ফেসবুক লাইভে এসময় তার সঙ্গে ছিলেন কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের এশিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক মিলন।
লাইভে এক পর্যায়ে মমিনুল হক বলতে শোনা যায়, প্রথমবারের মতো ‘আমিই’ পুরস্কারটি দিয়েছি। আমি তো দিতেই পারি।
-
২০১৭ সালে কানাডা আদালতে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেওয়ার পর নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরাতে এমন একটি পুরষ্কারের বিষয়ে তোড়জোড় শুরু করে বিএনপি নেতারা। সেইসময় কানাডিয়ান ১ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার আর্থিক লেনদের এই চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ায় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অফ মিশন ইন এশিয়া মোঃ মোমিনুল হক (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের ভাগ্নে), পাবলিক রিলেশন ডিরেক্টর আর্সেলি ডিনাইস গ্র্যাঞ্জা এবং বাংলাদেশী রাজনৈতিক দল বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ূন কবিরের সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পান কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা। সেই আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টসও ইমেইল বার্তায় গণমাধ্যমে পাঠান কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেভিড ভিগনাউল্ট।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে ভিতরের কাহিনী, কতটা জালিয়াতি আর প্রতারণা করা হয়েছে এই পদক নিয়ে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন ও সাবেক দুই বারের প্রধানমন্ত্রী কতটা.. দেউলিয়াত্বের মধ্যে পড়ে আছে! একটা ভুঁইফোঁড় সংস্থার কাছে থেকে কোটি টাকা খরচ করে পদক নিয়ে এত আয়োজনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে গতকাল থেকে যে সমস্ত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তাতে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ উপাধি ও সনদ সবার কাছে হাসি তামাশার বিষয়ে পরিনত হয়েছে। এই ধরনের জালিয়াতি প্রতারণা শুধু বিএনপি কে নয় জাতি হিসেবে আমাদেরও বিশ্বের কাছে নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপন হতে হচ্ছে।
_______________________
লেখক:
মুঃ আতিকুর রহমান সুমন
সম্পাদক
চাঁপাই ট্রিবিউন
www.chapaitribune.com