🔹🔹🔹🔹🔹🔹🔹কবিতা🔹🔹🔹🔹🔹🔹
◾◾◾মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম◾◾◾
আমিনুল ইসলাম:
মুয়াজ্জিনের আজান, মোরগের ডাক
এবং কাকের কলরব
সম্মিলিত আবাহনে প্রভাতের আগমন,
যেন নকীবের ঘোষণায়
তসরীফ আনেন নবাব-
আমাদের আলোর অধীশ্বর!
আর সাথে সাথে
পৌরকর্মচারীদের ছুটাছুটি, শশব্যস্ততা।
ভোরের হাওয়া মেখে গায়ে
বসে আছি একা
তাসেম বোর্ডিংয়ের ছাদে।
বেলা হয়ে আসে,
আলোড়িত ক্ষীণতোয়া মহানন্দা।
ঘাটে লৈলারমণীর ভিড়, স্নান,
কাপড়কাচার ধুম,
কলসভরে জল নিয়ে যাওয়া ঘরে।
ডোঙায় শ্যালো ইঞ্জিনের ভটভটানি,
তাকিয়ে আছে যাত্রীরা কেউ কেউ
যদি দেখা যায় একচিলতে
সিক্ত নান্দনিকতা!
একবিংশ শতাব্দীর উঠোনে দাঁড়িয়ে
এ দৃশ্য আপনি দেখবেন না আর
অন্য কোথাও।
দিয়াড় হতে আগত মানুষ দলে দলে ঢুকছে শহরে
যেমন ঢুকেছিল মুক্তিযোদ্ধারা সজনতা
একাত্তরের মধ্য-ডিসেম্বরে।
না! তাদের চোখেমুখে
কোনো রক্তাক্ত পরিকল্পনা নেই।
গাঁট শূন্য করে
বিকেলের রোদ মেখে
তারা ফিরে যাবে গাঁয়ে-
সঙ্গে নিয়ে বউয়ের শাড়ি,
নাতনীর আবদার,
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন;
অথবা
নিয়তির মতো ঝুলে থাকা
দেওয়ানী মামলার নতুন তারিখ।
আর রাতে রাতে
হাইলার পেটের মতো ফুলে উঠবে শহর!
বাইনোকুলারে আমার চোখ-
এপারে রেহাইচর-
ওপারে মহারাজপুর-
চকলামপুরের আম্রকানন,
থোকা থোকা আম-
ল্যাংড়া ক্ষীরসাপাত মোহনভোগ
স্বর্গীয় লোভের মতো ঝুলে আছে
হাতের নাগালে, নাকের ডগায়;
রসনায় জল এসে যায়।
আর ছায়া।
আর প্রকৃতির কিন্নরী
কোকিল শ্যামার গান, খঞ্জনার নাচ।
মাঝখানে বয়ে চলে মহানন্দা-
সর্পিলা অলকনন্দা বরেন্দ্রীর।
ও বাতাস! অক্সিজেন ভরে আসে বুক।
আহা! আমের ট্রাকে যদি তার
নেয়া যেতো কিছুটাও
রুগ্নতার রাজধানী ঢাকায়!
জন্নাত-স্বর্গ-হেভেন !
কী আর বেশি পাবেন মহাগ্রন্থসমূহে?
আজ ঝড়ুদা নেই;
নানানাতির হাতে বিটিভির ফরমায়েশ
ওদিকে রনবীকে আটকিয়েছে
টোকাইয়েরা- রাজধানীর রাস্তায়;
তবে কে আর আঁকবে
এই স্বর্গভূমির ছবি? কাউকে দেখি না।
এই যে মহানন্দা- দেবরাজের বর
ছিল কি না কে জানে!
এই জলের আরশীতে বিম্বিত
মহাজীবনের জলছবি।
ওই যে বারঘারিয়ার ঘাট- আজ মাঝিশূন্য,
একদিন ওই ঘাটে এসে থেমেছিল
তুর্কীদের ঘোড়া
সাম্যের সওয়ারী বয়ে কাঁধে;
আর নক্ষত্রের মতো হেসে উঠেছিল
প্রাকৃত নারীর চোখ!
এই জলেই মুখ দেখে আপন,
তলোয়ার রেখে জমিনে
মাটি চুমেছিলেন সুলতানের সেনাপতি।
আজ কোথায় সে মরুর অরণ্য!
আর কোথায় সে প্রত্যাদেশ!
গৌড়ে সে ঘুমায় আজো
সোনামসজিদের স্বর্গশাসিত ছায়ায়।
নানার হুঁশিয়ারী মেনে
নবাব কি এসেছিলেন ছুটিয়ে ঘোড়া
আমাদের এই রেশমী উদ্যানে?
তাই কি নবাবগঞ্জ!
তারপরও এসেছে শ্বেতলুটেরা!
আমের বাগান দষ্ট-পেয়ালার মতো
ভরেছে নীলের বেদনায়!
আর জমিদার?
সে তো মড়ার ওপর খাড়ার ঘা।
তারপর সাতচল্লিশ মাড়িয়ে একাত্তর;
ক্যাপটেন জাহাঙ্গীর-
বীরবংশের উত্তরাধিকার
বুক দিয়েছে মহানন্দায়।
ওই তো রেহাইচরের ঘাট!
মহানন্দায় সেতু-
জাহাঙ্গীরের প্রশস্ত কাঁধ
হাত বিছিয়ে দু’পাড়ে-
আর দৃপ্ত পায়ে পার হয়ে আসে স্বাধীনতা!
থেমে এসেছে কাঁসারিপট্টির টুঙটাঙ;
মানিক সরকারের আলকাপের গলা-
না, সেও আর আসে না কানে।
উজানের শাপে মালোদের নৌকাগুলো
ধরেছে চুলোর পথ
জানি না- সে কী আশায়
দেড় বাঁও জল নিয়ে বুকে,
শ্মশানবৈরাগীর মতো বসে আছে
বুড়ি খালঘাট
স্মৃতিবন্দী ফতুর উঠোনে।
আমাদের একজন অদ্বৈতমল্ল নেই;
থাকলে আমরাও পেতাম:
কালের স্রোতে
মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম।
লেখা: আমিনুল ইসলাম