হারুন অর রশিদ: অচীনপুর গ্রামের মধুলালের দুই মেয়ে পুষ্পিতা ও স্বপ্না। দুই জন বন্ধুর মতো ছোট থেকে বেড়ে উঠেছেন। স্বপ্নার বাবা মধুলাল খুব গরীব পরিবারের সন্তান। তাই সে নিজে পড়াশোনা ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেননি। কিন্তু মেয়েদের ঠিকই পড়াশোনা করিয়েছেন। দুই বোনের ছোট বোন স্বপ্না সহকারী শিক্ষক এবং বড় বোন পুষ্পিতা প্রধান শিক্ষক। তাদের স্বপ্ন ছিল বড় কোন কর্মকর্তা হবেন। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে কাজের চাপে চাকরির পড়াশোনা করার সুযোগই পাচ্ছিলেন না। তারপরও বাবার অসহায়ত্ব দেখে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিতেই যোগদান করলেন। তারা ভেবেছিলেন, হয়তো তারা চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে বড় কর্মকর্তা হবেন। তাই অতোটা চিন্তা করেন নি। এইভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু হলো দুই বোনের।
কয়েক বছর কেটে গেল। পুষ্পিতা ও স্বপ্নার বিয়ে হয়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ তারা যখন কোন খবর শোনে পদোন্নতি হবে তাদের মুখে হাঁসি ফুটে উঠে। আবার কিছুদিন পর সেই স্বপ্ন নিথর পাথরের মতো শক্ত হয়ে পড়ে থাকে। এইভাবে দেখতে দেখতে ১৫ বছর কাটিয়ে দিলো। একদিন তারা শুনতে পেলো এবার নিয়োগ বিধি পরিবর্তন হচ্ছে। আর অল্পকিছু দিনের মধ্যেই নিয়োগ বিধির ফাইনাল হবে। আর কোন শিক্ষক নিয়োগ হবেনা। শতভাগ পদোন্নতি পাবেন সকলে। যুগ্মসচিবও হতে পারবেন শিক্ষকেরা। তাদের খুশির জোয়ার আবারো শুরু হলো। পাখির কলতানে আকাশে বাতাসে সুমধুর ছড়াচ্ছে। দুই বোন মোবাইলে কল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করলেন। ছোট বোন নদী বললেন,জানো পুষ্পিতা তুমি কর্মকর্তা হবে। আর সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে নিয়োগ হবে না। ৮০% পদোন্নতি দিবে। আর আমাদেরও প্রমোশন হয়ে প্রধান শিক্ষক হবো।
বড় বোন পুষ্পিতা বললো, তুই কার কাছে শুনলিরে বোন এসব কথা। আগেও তো শুনেছি কিন্তু হয়নি তো। ছোট বোন নদী বললো, আমি সরাসরি আমাদের সচিব স্যারের কথা শুনলাম, তিনি বারবার বললেন, আর কোন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেবো না, এখন থেকে সহকারী শিক্ষক থেকে শতভাগ পদোন্নতি হবে। আর তোদের কথা বললো সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে ৮০% পদোন্নতি দিবে।
কয়েকদিন পর তারা বাবা মধুলালের বাসায় বেড়াতে গেলো দুই বোন। বাবাকে খবরটা দিতেই বাবা কেঁদে চোখ মুছতে শুরু করলেন। পাশের বাড়ির নদীর ও পুষ্পিতার কাকী লাবণ্য বললো, আপনি কাঁদছেন কেন? মধুলাল বললো, অনেক স্বপ্ন ছিল আমার, আমি পড়াশোনা করিনি। মেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি। তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করতে চায়নি। বড় চাকরি করবে তাই। আমার অসহায়ত্ব দেখে এই চাকরিতে ঢুকেছে। আমার মেয়ে পুষ্পিতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে ১ম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। আর ছোট মেয়ে স্বপ্না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২য় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। আজ তারা বড় কর্মকর্তা হবে তা শোনেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছি।
এইভাবে স্বপ্ন দেখতে দেখতে আরো ১০ বছর কেটে গেল। আজ ২৫ বছরে তাদের আশার স্বপ্ন জোয়ারে টেনে নিয়ে গেছে। শুন্য মরুর মতো তাদের চোখে মুখে শুধুই হাহাকার। তারা আর স্বপ্ন দেখে না। তারা আর স্বপ্ন দেখার কথা শোনতেও পছন্দ করে না। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তারা সামান্য এই বেতনে পরিবার নিয়ে ঠেলাগাড়ির মতো জীবন পরিচালনা করছেন। প্রাথমিক শিক্ষক এরা শুধুই স্বপ্ন দেখে, শুধুই উপরের দিকে চেয়ে থাকে, এই বুঝি বৃষ্টি এলো। এবার হয়তো নতুন ধান ফলবে। স্বপ্নছোয়া ভালোবাসা জড়িয়ে বাবাকে নতুন শার্ট ও মাকে লাল সবুজের শাড়ী কিনে জড়িয়ে বলবে মা আজ আমি সার্থক।
প্রাথমিক শিক্ষক, এরা স্বপ্ন দেখে, আর দেখতে দেখতেই চাকরি শেষ করেন। এই চাকরি জীবনে ভয়ভীতি, তিস্কার,শাসন, অন্যায়কে ন্যায়, বড় কর্মকর্তাদের মিষ্টি মুখ করানোসহ সব কিছুই এই প্রাথমিক শিক্ষক করে থাকেন। সারা জীবন “অ” “আ” “ক” “খ” করতে করতেই মুখে ফ্যানা তোলেন। তাদের কাছে পড়াশোনা করে যারা বড় কর্মকর্তা হোন তারায় আবার সেই শিক্ষকদের বলেন, “এরা পড়ান না” কত অসহায় চোখে আর কত নিরুপায় হয়ে এই কথাগুলো শোনতে হয় যারা শিক্ষক তারায় বোঝেন। আবার এতো কিছু করার পর শেষ পর্যায়ে এসে যে একটা সম্মাননাও পাবেন তা শিক্ষক পান না। অসহায়ত্ব নিয়ে, চোখে পনি জমিয়ে নিরব কান্নায় অবসরে চলে যান। জীবনের প্রাপ্তি বলতে একটা জিনিস শিক্ষকেরা পান তা হলো আপনি শিক্ষক আপনার সম্মান, মর্যাদা সবার…. উপরে।