আবুল কালাম আজাদ( রাজশাহী):- বাংলাদেশের সর্বপশ্চিমের জেলা চাঁপানবাবগঞ্জে অবস্থিত বিখ্যাত আমনুরা জংশনটি একটা সময় ডাবল জংশন ছিল? বর্তমানে অবশ্য এটি সিঙ্গেল জংশন হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
আব্দুলপুর জংশন থেকে একটি ব্রডগেজ লাইন রাজশাহী স্টেশনের উপর দিয়ে এখানে এসে দুটি সেকশনে বিভক্ত হয়েছে। একটি লাইন চলে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর পর্যন্ত, আর অন্যটি চলে গেছে রহনপুর হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে। কিন্তু এ ছাড়াও আরেকটি মিটারগেজ সেকশন ছিল এই আমনুরা জংশন থেকে রাজশাহী জেলার পদ্মা তীরবর্তী গোদাগাড়ী ঘাট পর্যন্ত, যা আজ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত।
বিলুপ্ত আমনুরা – গোদাগাড়ী ঘাট মিটারগেজ সেকশনঃ-
বর্তমান আমনুরা জংশন থেকে গোদাগাড়ী ঘাট পর্যন্ত মিটারগেজ সেকশনটি ছিল প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেকশন। এই ২৪ কিলোমিটার অংশে রেলস্টেশনগুলো ছিল – আমনুরা জংশন, দীগ্রাম, গোদাগাড়ী এবং গোদাগাড়ী ঘাট।
দেশভাগের পূর্বে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গোদাগাড়ী ঘাট থেকে আমনুরা জংশন – নাচোল – রহনপুর – সিঙ্গাবাদ – মালদা হয়ে ভারতের বিহার রাজ্যের কাটিহার পর্যন্ত ছিল মিটারগেজ সেকশন।
অন্যদিকে আবদুলপুর জংশন থেকে রাজশাহী – আমনুরা – চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত অংশটি ছিল ব্রডগেজ সেকশন।
১৯০৯ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি গোদাগাড়ী ঘাট থেকে আমনুরা জংশন – রহনপুর – সিঙ্গাবাদ হয়ে মালদা পর্যন্ত মিটারগেজ সেকশন চালু করে কাটিহার ডিভিশনের অধীনে। সেই সময় কলকাতা (বর্তমানে শিয়ালদহ) থেকে বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা ঘাট পর্যন্ত (পদ্মার দক্ষিণ পাড়) ব্রডগেজ ট্রেনে আসার ব্যবস্থা ছিল। এরপর লালগোলা ঘাট থেকে ফেরিতে করে পদ্মানদী পার হয়ে পদ্মার উত্তর পাড়ে, বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ঘাটে পৌঁছে সেখানে অপেক্ষমাণ মিটারগেজ ট্রেনে চেপে আমনুরা জংশনের উপর দিয়ে সরাসরি মালদা, কাটিহার (বিহার রাজ্য), শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গের যেকোন জায়গায় চলে যেতে পারত এই পথের ট্রেনযাত্রীরা। দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত এই যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে গোদাগাড়ী ঘাট – আমনুরা – রহনপুর মিটারগেজ সেকশনটি একটা বিছিন্ন ছোট মিটারগেজ সেকশনে পরিণত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার (ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে) জরুরি ভিত্তিতে আমনুরা থেকে রহনপুর পর্যন্ত মিটার গেজ সেকশনটিকে ব্রডগেজে উন্নীত করে। অন্যদিকে, গোদাগাড়ী ঘাট থেকে আমনুরা জংশন পর্যন্ত মিটারগেজ সেকশনটি যাত্রী পারপার না হওয়ার কারণে অলাভজনক হয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ সেকশনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং সেই সাথে এই সেকশন থেকে লাইনগুলোও তুলে ফেলা হয়, আর এভাবেই বাংলাদেশের রেলের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় আমনুরা জংশন – গোদাগাড়ী ঘাট মিটারগেজ সেকশনটি।
অবশ্য বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এই আমনুরা জংশন – গোদাগাড়ী ঘাট সেকশনের কিছু স্মৃতিচিহ্ন কিন্তু এখনও রয়ে গেছে। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গামী ট্রেনগুলোর আমনুরা জংশনে গিয়ে আবারও লোকোমোটিভ ঘুরিয়ে নেয়ার ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমনুরা জংশন থেকে সামান্য আগে একটি বাইপাস স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে, যা আমনুরা বাইপাস নামে পরিচিত। এই বাইপাস স্টেশনের ঠিক পিছনের দিকেই একটা মাটির কাঁচা রাস্তা দেখতে পাবেন। এইদিক দিয়েই গোদাগাড়ীর দিকে চলে গিয়েছিল সেদিনের সেই আমনুরা – গোদাগাড়ী ঘাট রেল সেকশন, আজও ঐ অংশটুকু বিলুপ্ত ও বিস্মৃত এই সেকশনটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এছাড়া গোদাগাড়ী ঘাট অঞ্চলে ‘রেল বাজার জামে মসজিদ’ নাম নিয়ে থাকা মসজিদ, রাজশাহী – চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে গোদাগাড়ী রেলগেট ক্রসিং, এমনকি ঘাটের রেল লাইনের আশেপাশে গড়ে ওঠা ‘রেলগেট বাজার’ নামের বাজারটিও সাক্ষী দেয় আমনুরা – গোদাগাড়ী স্টিমার ঘাট রেলপথের সুন্দর এক অতীতের।
পদ্মানদীর উত্তর পাড়ের আমনুরা জংশন – গোদাগাড়ী ঘাট সেকশনটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পদ্মার অপর তীরে ভারতের মুর্শিদাবাদের লালগোলা ঘাট – শিয়ালদহ ব্রডগেজ সেকশনটি কিন্তু এখনও আগের মতই সচল রয়েছে। প্রতিদিন শিয়ালদহ থেকে লালগোলা পর্যন্ত গন্তব্যে তিনটি এক্সপ্রেস ট্রেন (আমাদের দেশের আন্তঃনগর সমমান) – হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস, ভাগীরথী এক্সপ্রেস ও ধনধান্য এক্সপ্রেস ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈদ্যুতিক লোকাল প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল করে থাকে।
অপরদিকে ৬০ এর দশকের শেষের দিকে ভারতীয় রেলওয়েও তাদের সিঙ্গাবাদ পর্যন্ত অংশটিকে মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রুপান্তরিত করে। ১৯৮০ এর দশকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রহনপুর রেলস্টেশন থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মালদা জেলার সিঙ্গাবাদের সাথে রেলপথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত করে। বর্তমানে এই রেল করিডোর দিয়ে বর্তমানে শুধুমাত্র মালবাহী ট্রেনগুলো চলাচল করে থাকে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানি – রপ্তানি কার্যক্রম চলে থাকে। আপাতত এখনও কোন যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হয়নি।