আগস্ট বেদনাবিধুর শোকের মাস

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১, ২০২৩

রাশিক দত্ত: আগস্ট শোকের মাস, রক্তঝরা বেদনাদায়ক মাস আগস্ট। এই মাস বেদনাবিধুর শোকের মাস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক চরম কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো এই মাসে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী ১৫ আগস্ট বাঙালির জন্য অশ্রঝরা কালো একটি দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে মুক্তি ও তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য যিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু কারাভ্যন্তরে কাটিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বাধীনতা সংখামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার তর্জনী হেলানো জ্বালাময়ী ভাষণে বাঙালি জাতি বীর যোদ্ধার বেশে বেরিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করতে, সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ৭৫এর ১৫ আগস্টে। এই নরপিশাচ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই দিনে বাঙালির ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। কতিপয় চক্রান্তকারী সেনাসদস্য নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। তাদের বর্বরতা থেকে শিশু ও নারীরাও রেহাই পাননি। যার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি, বিদেশী কুচক্রী মহল। সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুই আস্তে আস্তে জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপর খন্দকার মোশতাক স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও মেজর জিয়া সেনা প্রধানের দায়িত্বে এসে তাদের কলুষযুক্ত চেহারা উম্মোচন করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ঘাতকের বুলেটে নিহত হন তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্ত্ঃসত্ত্বী স্ত্রী আরজু মনি এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে হত্যা করার পর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে যায় ঘৃণার বিষবাষ্প। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে বাঙালি জাতি সেদিন ভাগ্য ক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ও শেখ রেহানা।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম এক অপকর্ম। পরের ২১ বছর খুনিরা যেভাবে দায়যুক্ত ছিল তাও আরেক কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। খন্দকার
মোশতাকের স্বাক্ষরকৃত অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন।

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। সে সময় বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জনাব সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল । সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল “সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯।” এটি এখন সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত আছে।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেওয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ওই বছর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয় । এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকের দল দেশকে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ২১ বছরের অন্ধকার যুগের পর আবার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে হাটতে থাকে৷ জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এই চলার পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন সোনার বাংলা গড়ার। তিনি জাতির মুক্তির জন্য কাজ শুরু করেছিলেন যার জন্য তিনি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, প্রগতিবাদ আর সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক ধারার সূত্রপাত করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন । তা বাস্তবায়ন করার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় জাতির জনককে।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত সেসব খুনি দীর্ঘদিন ছিল বিচারের আওতাবরহির্ভূত। ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সচল হয়। মাঝে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই বিচার ঝুলিয়ে রাখে তখনকার বিএনপি নেতৃত্বে থাকা জোট সরকার আবার আওয়ামী লীগ সরকারে ক্ষমতায় আসলে আদালতের চুড়ান্ত রায় কার্যকর হয়।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ত্যাগ, দূরদর্শিতা এবং অকুতোভয় আপোসহীন নেতৃত্বে দেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশমাতৃকা মুক্ত হয়েছিল৷ বাঙালি জাতি পেয়েছিল হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় স্বাধীনতা, স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র। বজ্রকণ্ঠে তিনি ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে রক্তনদী পেরিয়ে অর্জিত হয়েছিল মহার্থ স্বাধীনতা। যে বিশাল হৃদয়ের মানুষকে কারাগারে বন্দী রেখেও স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, অথচ স্বাধীন বাংলার মাটিতেই তাকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে।

শোকার্ত বাঙালি জাতি আগস্ট মাসজুড়ে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করবে বাঙালি জাতির এই মহানায়ককে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি সে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে এ মাস।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ৷ হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম ঘুচিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উন্নয়নের ‘রোল মডেল”। উন্নয়নের মহাসড়কে ডিজিটাল বাংলাদেশ। টার্গেট রূপকল্প-২০৪১। এর মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে জাতি। দেশবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র দক্ষভাবে মোকাবিলা করার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শোকের আগস্টে জাতির পিতার আদর্শে উজ্জীবিত জাতি আবার নতুন করে সোনার বাংলা বিনির্মাণের শপথ নেবে। শোকবহ আগস্টের শুরুতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি সকল শহীদদের।

লেখক:
রাশিক দত্ত
সভাপতি, রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগ।
সাংগঠনিক সম্পাদক, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগ।

পোস্টটি শেয়ার করুন