জলবায়ুর বৈরি চাপে বরেন্দ্রভূমির নয়া দুর্ভোগ

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৬, ২০২৩

আব্দুল আলীম খোকন: জলবায়ুর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জলবায়ু হচ্ছে কোনো এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়া। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি দ্রুত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা নামে বেশ পরিচিত। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন- অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি। যার ফলশ্রুতিতে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকায় যে খরা, বন্যা, অনাবৃষ্টি এমনকি ঘূর্ণিঝড় এর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে এবং এই এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভঙ্গুর।

জলবায়ু পরিবর্তন এর ফলে যে প্রভাব সারা বিশ্বব্যাপী পড়ে তা মূলত মানব সৃষ্ট কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপি জলবায়ুর পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই নয়, এর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণও সামিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিপর্যয়ের এই ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ্যাকশন প্ল্যান-এ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কিনা, তা চারটি মানদন্ডে বিবেচনা করা হয়: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য এরই মধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের উপর।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্রদাহ, খরা এবং জলবায়ু পরির্বনের কারণে নতুন নতুন কিছু সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরার কারণে পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পানিকে কেন্দ্র করে বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে ফলে নলকূপের পানি প্রাপ্যতা অনেক কমে গেছে। বিকল্প পানির ব্যবস্থা হিসেবে যেসব পানি ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।

কৃষিতে চাষাবাদের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন তার যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে ফলে আশানুরূপ ফসল ফলাতে কৃষকগণ ব্যর্থ হচ্ছে। এই অঞ্চলের কৃষিকাজ দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টির উপযোগী। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, ধানের ফুল আসার সময় থেকে বীজ বের হওয়ার মাঝখানের সময়টুকুতে প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় টি-আমন জাতের ধানের উৎপাদন কমে আসছে। এমনকি ভরা বর্ষায় অনাবৃষ্টিতে আমন ধানের বিশাল খেত রোদে পুড়ছে। যেখানে আমন ধান রোপনের অন্তত ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত পানি ধরে রাখা নিশ্চিত করতে হয়, নাহলে কুশি বাড়ে না; সেখানে পানির অভাবে জমিতে ফাটল দেখা দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পে, লাক্ষা চাষ, আম চাষ এর উপরও প্রভাব ফেলেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিক তাপমাত্রা উঠা নামার কারণে রেশম পলু পোকা পালনে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছেন পলু পোকা চাষীরা। বেড়েছে তাদের উৎপাদন খরচও। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম লাক্ষা চাষেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রচন্ড তাপদাহের কারণে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কেননা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে একই সময়ে আম দ্রুত পেঁকে যায় ফলে তা সময় মতো ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অন্যদিকে মানুষ দৃষ্ট দুর্যোগগুলোও বরেন্দ্র জনগন এবং এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি ডেকে আনছে। অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। আবার কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা তাদের ক্ষতি অনুযায়ী ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ৩০% জমি কোনো না কোনো ভাবে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এমন কি কোনো এলাকায় তারও বেশি পরিত্যাক্ত জমি থেকে যাচ্ছে। একই সাথে প্রান্তিক কৃষক জমি হারাচ্ছে। সমীক্ষা এলাকায় ১০টি কেস স্টাডির মাধ্যমে দেখা যায় ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত গড়ে অন্তত ১০টি পরিবার তার ৭০% জমি হারিয়েছেন।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলটি প্রাণবৈচিত্র্য ও বহুসংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ এক অনন্য ঐতিহ্যবাহী আদিভূমি। নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সহবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। কিন্তু দিনে দিনে বৈশ্বিক জলবায়ুর আঞ্চলিক অভিঘাত এবং মনুষ্যসৃষ্টসহ নানা কারণে প্রাণবৈচিত্র্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, উঁচু-নীচু ভূমি, মাঠ, খাল-খাড়ি, বিল, নদ-নদী, পুকুর, প্রাকৃতিক জলাধার, বন আজ অনেকটাই হুমকির মুখে। এই বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণ ও সংস্কৃতিও হুমকির মুখে। তাই এখন এই হুমকির দ্বার থেকে বের হয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে, বরেন্দ্রভূমিকে স্বর্ণভূমিতে পরিণত করা এখন সময়ের ব্যাপার।

তাই একদিকে যেমন শিল্পোন্নত দেশগুলোর উচিৎ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করা এবং ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া অন্য দিকে দেশের সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা। এরই মধ্যে বর্তমান সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা বরেন্দ্র ভূমিকে সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাবার ড্যাম এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় যা দিয়ে এই অঞ্চলের অন্তত ক্রান্তিকালীন সময়ের পানির সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। কৃষিকাজে এমনকি মৎস্যচাষে এই রাবারড্যাম বেশ উপযোগী হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। সর্বপরি এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও এগিয়ে নিতে, এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমান আরও উন্নত করতে দরকার বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্পা যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বরেন্দ্রভূমি হবে বাংলাদেশের এক অনন্য উন্নয়ন হাব।

__________
লেখক:
পরিবেশ ও সমাজ বিষয়ক কলামিস্ট,
এবং শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

পোস্টটি শেয়ার করুন