কোচিং বাণিজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট শিক্ষার্থী, বাধাগ্রস্থ মেধা বিকাশেও

Chapai Chapai

Tribune

প্রকাশিত: ৫:১৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩

আবুল কালাম আজাদ (রাজশাহী): প্রাথমিক শিক্ষাক্রম একটি যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। পাঁচ বছর মেয়াদি শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা কী কী যোগ্যতা অর্জন করবে তা সুনির্দিষ্ট আছে। এগুলোকে বলা হয় প্রান্তিক যোগ্যতা। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষায় ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোকে আবার বিভাজিত করা হয়েছে বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতায়। একটি বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা কোন শ্রেণিতে কতটুকু অর্জন করবে তাও সুনির্দিষ্ট। এগুলোকে বলা হয় শ্রেণিভিত্তিক অর্জনোপযোগী যোগ্যতা। বর্তমানে ক্রমান্বয়ে শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার দিকে প্রাথমিক স্তরকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন হলো, বছর শেষে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিভিত্তিক অর্জনোপযোগী যোগ্যতা কতটুকু অর্জন করতে পারল তা যাচাই করা_ সেটিও আবার শিখনের স্তরভিত্তিক (জ্ঞানমূলক, উপলব্ধিমূলক, প্রয়োগমূলক-উচ্চতর দক্ষতা) হতে হয়। আশা করা হয়েছিল, উপযুক্ত শিখন-শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষকরা বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট শ্রেণিভিত্তিক অর্জনোপযোগী যোগ্যতা অর্জন করাবেন এবং সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে।

এককালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রাইভেট টিউশন প্রচলিত ছিল শুধু ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে। এ টিউশনে বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পরীক্ষার আগের কয়েক মাস পড়ানো হতো। মনে আছে, আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন বৃত্তি পরীক্ষার জন্য বছরের শেষ তিন মাস একজন শিক্ষকের কাছে ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেট পড়েছিলাম। বর্তমানে বছরজুড়ে সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে এবং এটা চালু হয়েছে প্লে, নার্সারি বা প্রথম শ্রেণি থেকেই। কিশোরগঞ্জ শহরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়ীক তাহসীন রাতুল বছরের শুরু থেকেই একটি কোচিং সেন্টারে পড়ছে। মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার কথাও হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এসব একাডেমিক কোচিং সেন্টার। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত এসব কোচিং সেন্টার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে ভূমিকা পালন করায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি যেমন কমেছে, তেমনি শিক্ষকরাও প্রতিষ্ঠানে সময় না দিয়ে ব্যক্তিগত কাজে (কোচিং বা টিউশনি) জড়িয়ে গেছেন। শহরের অনেক বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্ন বিরতির পর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসে শিক্ষার্থী পাওয়াই যায় না।

গত শতকের নব্বই দশকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিশেষ প্রয়োজনে প্রাইভেট-কোচিং প্রচলিত হয়েছিল। সময়ের পরিবর্তনে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন-সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাইভেট বা কোচিংয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে_ এমনটি মনে করেছিলেন শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু বাণিজ্যিক দিক বিবেচনায় প্রাইভেট-কোচিং আরও ব্যাপকভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকদের একাংশ। সরকার শিক্ষা-আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। তাই সরকার প্রাইভেট-কোচিংয়ে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য শাস্তির বিধান রেখে শিক্ষা আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এ আইনের লক্ষ্য হলো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখী করা।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকার প্রাথমিক স্তরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চালু করেছে সরকার। এ অবস্থায় বাস্তবতা হলো, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রাইভেট-বাণিজ্য বা কোচিং-বাণিজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন ভুক্তভোগী অভিভাবকরা। কোমলমতি শিশুদের কাছে স্কুলের মুক্ত আঙিনাকে আনন্দময় করার বদলে স্কুলকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা হচ্ছে দিন দিন। অনেক শিশু স্কুলের পরিবর্তে প্রাইভেট শিক্ষকের বন্দি কক্ষে সেরে নিচ্ছে পড়াশোনা। সমাপনী পরীক্ষার জন্য পঞ্চম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী সারা বছর স্কুলেই যায় না। শুধু বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র। বছরের প্রথম মাস থেকেই শুরু হয় এসব প্রাইভেট বা কোচিং। অনেক অতি উৎসাহী অভিভাবক আবার তাদের সন্তানকে সকালে এক কোচিং, বিকেলে আরেক কোচিংয়ে পাঠান। অনেক অভিভাবক কোচিং-প্রাইভেট দুটিই চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে অভিভাবকদেরও গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত পড়ার বোঝা। প্রাইভেট না পড়লে বিদ্যালয়ে গিয়েও পাচ্ছে না শিক্ষকের সুদৃষ্টি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণিতেই ছলে-বলে-কৌশলে শিশুদের প্রাইভেটমুখী করছে এক শ্রেণির শিক্ষা-ব্যবসায়ী কথিত শিক্ষক।

প্রাথমিক স্তরের প্রাইভেট-কোচিং সেন্টারগুলো শিশুদের জন্য হয়েছে মরণফাঁদ। বেশিরভাগ প্রাইভেট-কোচিং সেন্টারের ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয় দুপুরের পর অথবা সন্ধ্যাবেলায়। সারাদিন ক্লান্তির পরে কোমলমতি শিশুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয় প্রাইভেট-কোচিং সেন্টারে। ব্যাগভর্তি বই-খাতা-পেন্সিল নিয়ে এসব শিশু সারাক্ষণ শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতায় ভোগে। কিন্ডারগার্টেনের প্লে-নার্সারি থেকে কেজি-ফাইভ পর্যন্ত অধিকাংশ শিশু-শিক্ষার্থীই প্রাইভেট-কোচিংয়ের ফাঁদে আটকে থাকে। প্রাথমিক স্তরে এ প্রাইভেট-কোচিং শিশুদের শৈশবকে ধ্বংস করছে এবং সৃজনশীলতার বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে তুলছে।

একটি শিশু স্কুলে ভর্তি হয়েই জেনে যায়_ স্কুল তার জন্য যথেষ্ট নয়। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য তাকে দৌড়াতে হবে প্রাইভেট টিউটরের বাসায়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারগুলো নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জনের দিকে নজর না দিয়ে পরীক্ষায় কীভাবে বেশি নম্বর পাওয়া যায় সেদিকে নজর দিচ্ছে বেশি। শিক্ষার্থীদের ভিত্তি তৈরির দিকে তাদের কোনো নজর নেই। নেই নজর নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার দিকেও।

স্কুলবিমুখ হওয়ার এ মানসিকতা পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও তার মনে বদ্ধমূল থাকে। এ কারণেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার দিন দিন বাড়ছে। শহরাঞ্চলের কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যতীত গ্রামের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীর উপস্থিতি হতাশাজনক। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা যদি শিশুদের প্রাইভেট কিংবা কোচিং করা বন্ধ করেন এবং শতভাগ শিশুকে স্কুলমুখী করতে যত্নবান হন, তবে পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলমুখী হওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হবে। প্রাইভেট বা কোচিংমুখী হওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে। তাই প্রাথমিক স্তরে সর্বাগ্রে প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রাথমিক স্তরে প্রাইভেট-কোচিং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। শিশুর শৈশব ও বেড়ে ওঠার অমিত সম্ভাবনাকে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত রাখতে সব মহলের আন্তরিক সদিচ্ছা ও ঐকান্তিকতা একান্ত জরুরি। শিশুদের জন্য স্কুলের আঙিনাকে আনন্দময় ও অনুকূল করার পাশাপাশি তাদেরকে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। শিশুকে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও সৃজনশীল পদ্ধতিকে ফলপ্রসূ করতে কোচিং ও প্রাইভেটের ওপর নির্ভরতা কমানোই হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

পোস্টটি শেয়ার করুন